আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন? (Are you forgetting?)

হঠাৎ করেই আপনার স্মরণশক্তির কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে? গত সপ্তাহে, কোনো নির্দিষ্ট দিনে আপনি কী কী করেছেন, ঠিকঠাক মনে করতে পারছেন না। বা কথা বলছেন কারও সঙ্গে, একটি নাম আপনার মনে এসেও আসছে না। কাউকে ফোন করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু ভুলে গেছেন। পড়া হয়নি ভেবে কোনো বই পড়তে শুরু করেছেন, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন বইটি আপনার আগে পড়া।

আপনি একা নন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউন আমাদের অনেকেরই স্মরণশক্তিতে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট মিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ক্যাথেরিন লাভডের গবেষণায় অংশ নেওয়া অন্তত ৮০ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের স্মৃতিতে কিছুটা সমস্যা হয়েছে মহামারির সময়। প্রবণতা পুরুষের থেকে নারীদের বেশি।

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই তালিকায় প্রচণ্ড স্মৃতিধর মানুষও রয়েছেন, যাঁরা কিনা এখনো বহু আগের, এমনকি ২০ বছর আগে কোনো সিনেমার টিকিট কাটার ঘটনা মনে রেখেছেন, কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা হঠাৎই ভুলে যাচ্ছেন। আমাদের প্রায় সবারই প্রাত্যহিক দিনযাপনে পরিবর্তন হয়েছে মহামারির কারণে। বয়স, পেশা, দেশ বা করোনার প্রকোপভেদে হয়তো এ পরিবর্তনের মাত্রা বা ধরন ভিন্ন।

অনেকের ব্যস্ত জীবন নিমেষেই বদলে গেছে। ছেদ পড়েছে দীর্ঘদিনের অভ্যাসে। গবেষকেরা বলছেন, ক্লান্তি, অবসাদ, উদ্বেগ, একঘেয়ে পারিপার্শ্বিক, গৎবাঁধা জীবনযাত্রা এবং সামাজিক যোগাযোগের ঘাটতির কারণে আমাদের অনেকের স্মৃতিশক্তি কিছুটা কমেছে।

যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মহামারির কারণে অবসাদ আর উদ্বেগ অনেক বেড়ে গেছে। ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, অবসাদ আর উদ্বেগ আমাদের স্মরণশক্তির ওপর প্রভাব ফেলে। এই দুইয়ের কারণে স্মরণশক্তির জন্য মস্তিষ্কের কার্যকর ক্ষমতার বরাদ্দ কমে যায়। নতুন তথ্য জমা রাখার জন্য যে মনোযোগ দরকার, তাতে ব্যাঘাত ঘটে।

মস্তিষ্ক তথ্য বা ঘটনা তার ধরন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সংরক্ষণ করে। কোনোটা দীর্ঘদিনের, কোনোটা-বা ক্ষণিকের জন্য। আপনি বাজারে গিয়ে কী কী কিনবেন, কোথা থেকে কিনবেন, বাজার করার পর সেই তথ্য দীর্ঘক্ষণ মনে রাখার হয়তো দরকার নেই। কিন্তু আপনার বিয়ের আংটি আপনি কোন দোকান থেকে, কখন কিনেছিলেন, সেটা হয়তো মনে রেখেছেন।মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সক্রিয় অংশগ্রহণে তথ্য সংরক্ষণ আর প্রয়োজনমতো পরে তা ব্যবহার করা হয়। অনেকটা লাইব্রেরির মতো। বইগুলো একাধিক আলমারিতে কীভাবে সাজানো আছে তার তালিকা এবং সাজানোর গুণগত মানের ওপর বই খুঁজে পাওয়া নির্ভর করে। আবার নতুন বই লাইব্রেরিতে জায়গা করার জন্য ব্যবহার করা হয় না বা কাজে লাগে না—এমন বই সরিয়ে ফেলতে হয়। মস্তিষ্কে প্রতিনিয়তই নতুন তথ্য জমা, পুরোনো তথ্য মোছা আর প্রয়োজনমতো তা বের করে আনার প্রক্রিয়া চলে।

মস্তিষ্কে তথ্য সংরক্ষণের জন্য পারিপার্শ্বিকের, বিশেষ করে স্থানের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কীভাবে? বলছি। আপনার স্ত্রী বা প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম দেখার মুহূর্ত আপনার মনে আছে? ভেবে দেখুন। দেখা করার জায়গা, তার পাশে কী কী ছিল, এমনকি পোশাকের রং—সবই মনে আছে। কী কী কথা হয়েছিল, সেটাও মনে থাকার কথা। পাঁচ বছর আগে কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন। মনে করে দেখুন ওই জায়গার রাস্তাঘাট, চা বা কফির দোকান বা বিশেষ দ্রষ্টব্য, সবই আপনার চোখের সামনে ভাসছে। সঙ্গে টুকরো টুকরো স্মৃতি।আমাদের মস্তিষ্ক স্মৃতি ধরে রাখার জন্য পারিপার্শ্বিক অর্থাৎ আশপাশের স্থান, বিশেষ দ্রষ্টব্য সংযোগ বা সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে, অনেকটা সাইন পোস্টের মতো। প্রফেসর ক্যাথেরিন লাভডে বলছেন, ‘করোনার আগে আমরা প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাজে যেতাম। কাজে যাওয়ার সময় পরিবর্তনশীল পারিপার্শ্বিক, স্থাপনা, নতুন মানুষ আমাদের চোখে পড়ত। এসব দেখতে দেখতে আমরা যে তথ্য বা ঘটনাগুলো ভাবতাম, সেগুলো আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ী জায়গা করে নিত। ভিন্ন ধরনের পারিপার্শ্বিক ও বৈচিত্র্যময় দিনলিপি আমাদের স্মরণশক্তি তৈরিতে সহায়তা করে।’

লকডাউনে সকাল থেকে রাত কাটছে একই রুটিনে। চার দেয়ালের ভেতরে। পারিপার্শ্বিকেরও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। কাজের দিনের সঙ্গে ছুটির দিনের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ডের কথাই ধরুন, লকডাউন শুরু হওয়ার পরে প্রায় এক বছর, আমার মতো বহু মানুষ বাড়ি থেকে অফিস করেছে। চলাফেরা অত্যন্ত সীমিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। কেনাকাটা হয়েছে অনলাইনে। মাসের পর মাস বাড়ি থেকে বের হয়নি—এমন লোকের সংখ্যাও অনেক। সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছে বয়স্ক লোকদের, বিশেষ করে যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। মাসের পর মাস স্বজনহীন কেটেছে তাঁদের।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের মুখোমুখি বসে আগের মতো গল্প করা কমে যাচ্ছে। গল্পের বিষয়ও সীমিত। যেকোনো ঘটনা বা তথ্য অন্যকে বললে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আমাদের মস্তিষ্কের একটা ছোট অংশ হিপোক্যাম্পাস। আকারে ছোট হলেও কাজে অনেক বড়। সার্চ ইঞ্জিন বা লাইব্রেরিয়ান বলতে পারেন। মস্তিষ্কে তথ্য সংরক্ষণ আর খুঁজে বের করতে বড় ভূমিকা পালন করে এই অংশ। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, জীবনযাত্রা যখন চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, একঘেয়ে হয়ে যায়, তখন হিপোক্যাম্পাসের সক্রিয়তা কমে যায়। অন্যদিকে, নিয়মিত যাঁরা বাড়ির বাইরে যান, তাঁদের হিপোক্যাম্পাস অনেক সক্রিয়।

ভুলে যাওয়া ঠেকাতে প্রফেসর লাভডে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। বিধিসম্মত হলে হাঁটতে যেতে হব। সম্ভব হলে অপরিচিত পথে। যাতে আমাদের মস্তিষ্ক অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে। ঘরের মধ্যেও হাঁটা যেতে পারে। সৃজনশীল কাজ করতে হবে বাড়িতে বসেই। নতুন কিছু শেখা, বই পড়া, ছবি আঁকা বা গান গাওয়া। সম্ভব হলে এগুলো নিয়ে অন্যের সঙ্গে গল্প করা।

আরও আশার কথা হলো, এই স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। মহামারি শেষে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলেই মস্তিষ্ক আবারও পুরোমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠবে। আর কিছু স্মৃতি তো ভুলে যাওয়াই ভালো, বিশেষ করে তা যদি হয় মহামারির।

স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য, সাধারন স্বাস্থ্য-সমস্যা ও সমাধান, দৈনন্দিন স্বাস্থ্য-ঝুঁকি সম্পর্কে আপনার সাধারন জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে চোখ রাখতে পারেন-ঃ

YouTube (HealthSense)

Official Page (Health Sense Bangla)

Facebook Profile

Twitter (healthsense0819)

Instagram (healthsensebangla)

BlogSpot (Healthsensebangla)

Find Us on Maps

আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানুন এবং সুস্থ থাকুন।

No comments

Powered by Blogger.